FashionFEATUREDNewsStyle

যে কারণে পুরুষের লম্বা চুল নিয়ে সমাজে বিতর্ক

চুলের কাট নিয়ে ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার জাহানপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের ইস্যু করা এক চিঠি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখন চলছে তুমুল আলোচনা। চিঠিতে নাজিম উদ্দিন হাওলাদার এলাকার ‘সকল সেলুন দোকান মালিক ও কারিগরদের’ সতর্ক করা হয়েছে যে ‘সুন্নতি কাটিং, ডিফেন্স/আর্মি কাটিং’ ছাড়া অন্য কোনো কাট দিলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। যদিও এরই মধ্যে তিনি এ জন্য ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে সবার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। কিন্তু বিতর্ক থেমে নেই।

শুধু ভোলার নাজিম উদ্দিনই এমন বিতর্কে পড়েননি। এর কিছুদিন আগে শিক্ষার্থীদের লম্বা চুল কেটে দেয়ায় একজন মাদরাসা শিক্ষককে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার আগে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পর্যায়ের ১৪জন শিক্ষার্থীর চুল কেটে দেয়ার অভিযোগের তদন্ত চলছে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকার বিরুদ্ধে।

বাংলাদেশের সমাজে পুরুষদের লম্বা চুলকে ঠিক ভালো চোখে দেখা হয় না কেন?

চরফ্যাশনে চুলের কাট সংক্রান্ত নোটিস
ভোলার চরফ্যাশনের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আল-নোমান বিবিসিকে বলেছেন, চুলের কাট নিয়ে জাহানপুরের ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নাজিম উদ্দিন হাওলাদার যে নোটিস টাঙিয়েছিলেন ইউনিয়নের বিভিন্ন জায়গায় সেটি তিনি প্রত্যাহার করেছেন।

মঙ্গলবার নাজিম উদ্দিন হাওলাদারের স্বাক্ষরিত একটি নোটিস জারি করা হয়, যাতে ইউনিয়নের চুল কাটার দোকানের মালিক ও কারিগরদের সতর্ক করে বলা হয়েছিল, ‘সুন্নতি কাটিং, ডিফেন্স/ আর্মি কাটিং ছাড়া অন্য কোনো কাট দিলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

ওই নোটিস নিয়ে দেশব্যাপী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি হয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নোমান বলেছেন, উনি ওই নোটিসের জন্য দুঃখপ্রকাশ করে সব জায়গা থেকে সেটা উঠিয়ে নিয়েছেন। ওনার সাথে আমরা কথা বলেছি। উনি আসলে জানেন না যে ওইটা ওনার এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না। উনি বুঝতে পারেন নাই যে ওইটা ওনার কাজ না।

এই ঘটনাটি ছাড়াও গত এক মাসের মধ্যে বাংলাদেশে পুরুষের লম্বা চুল কেটে দেয়া নিয়ে আরো কয়েকটি ঘটনা সংবাদমাধ্যমে আলোচিত হয়েছে।

প্রশ্ন হলো কেন বাংলাদেশের সমাজে পুরুষের লম্বা চুল রাখা নিয়ে নেতিবাচক মনোভাব কাজ করে?

‘চুলের কাটে পৌরুষের প্রমাণ’
বিশ্লেষকেরা বলছেন, বহু বছর ধরেই চুলের কাটের সাথে পুরুষের লৈঙ্গিক পরিচয়কে যুক্ত করে ফেলা হয়েছে। ধরে নেয়া হয়, পুরুষের চুল হবে ছোট। কারণ সেটা পৌরুষদীপ্ত। পুরুষের মাথায় লম্বা চুল হলে সেটাকে মেয়েলি মনে করা হয়। এক্ষেত্রে সমাজে নির্ধারিত প্রচলিত ভাবনা হচ্ছে, পুরুষের চুল থাকবে ছোট আর নারীর চুল থাকবে বড়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জোবাইদা নাসরিন বলছেন, ‘যখনই পুরুষ চুল লম্বা করে, ধরে নেয়া হয় সমাজের ঠিক করা নর্মস তারা মানছে না। তাদের তখন বখাটে বা সমাজবিরোধী- এমন একটা দৃষ্টিতে দেখা হয়।’ তিনি বলেন, ইউরোপে রেনেসাঁ সময়কালে আধুনিক পুরুষের যে অবয়ব চিন্তা করা হয়েছে সেখানে পুরুষের ছোট চুল চিত্রিত হয়েছে।

অধ্যাপক জোবাইদা নাসরিন বলছেন, গত কয়েক শ’ বছর ধরে পুরুষের সামাজিক চেহারা হিসেবে তাকে ছোট চুলেই কল্পনা করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে যেসব চাকরিকে হোয়াইট কলার জব বা সম্মানজনক পেশা হিসেবে দেখা হয়, তার জন্য যেসব স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণ করা হয়েছে সেখানেও ছোট চুলকেই আদর্শ হিসেবে দেখানো হয়েছে। যে কারণে এর ব্যতিক্রমকে কাঙ্ক্ষিত মনে করা হয় না।

চুল নিয়ে চিন্তা
ভারতীয় উপমহাদেশে বা বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় বাউল, পীর ও মাইজভান্ডার ঘরানা কিংবা সুফি সাধকসহ শিল্প সাহিত্য চর্চার সাথে যুক্ত পুরুষদের লম্বা চুলের উদাহরণ রয়েছে। কিন্তু সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, পুরুষের ‘সিরিয়াস’, সফল ও আনুষ্ঠানিক ‘লুক’ হিসেবে যে অবয়ব ভাবা হয়, তাতে পুরুষের মাথার চুল ছোট থাকবে এমনটাই ভাবা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জিনাত হুদা ওয়াহিদ মনে করেন, চুলের সাথে রাজনীতি ও সমাজনীতির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তিনি বিষয়টি ব্যাখ্যা করছেন এভাবে, বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতি এখন এক ধরনের ট্রানজিশন বা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যে কারণে (চিন্তাধারা) একদিকে বিশ্বের আধুনিক স্টাইল বা ফ্যাশনের দিকেও যেমন যাচ্ছে, তেমনি একইসাথে কট্টর অনুভূতির দিকেও যাচ্ছে।

অধ্যাপক ওয়াহিদ মনে করেন, দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন সময় লম্বা চুল কেটে দেয়ার যেসব ঘটনা শোনা যায়, তার পেছনে মানুষের মনের অতিমাত্রায় রক্ষণশীল ভাবধারা কাজ করে। একজন মানুষের নিজস্ব পোশাক বা হেয়ারস্টাইল যে চাইলেই আরেকজন বদলে দিতে পারে না, সেই সহনশীলতা কমে যাচ্ছে সমাজে।

চুলের কাটের নাম
বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় ছেলেদের বিভিন্ন বাহারি হেয়ার কাটের নাম শোনা গেছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ দেশী ও বিদেশী চলচ্চিত্র অভিনেতা, মডেল ও সঙ্গীত তারকাদের অনুকরণে ফ্যাশনেবল চুলের ছাঁট জনপ্রিয়।

কেউ চুল কাটতে পছন্দ করেন ক্রিকেট ও ফুটবল তারকাদের অনুসরণে। কেউ আবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মতো ছোট ছাঁটে চুল কাটতে পছন্দ করেন। তবে সাধারণ নাতিদীর্ঘ চুলের বয়কাটও জনপ্রিয়।

সূত্র : বিবিসি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *