রপ্তানিতে প্রণোদনা চাই না, ব্যবসার খরচ কমান: সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর
নগদ সহায়তা বা ভর্তুকির পরিবর্তে ব্যবসার খরচ কমাতে নীতিনির্ধারকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর।
সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেছেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে গ্যাস-বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন পরিষেবায় খরচ বেড়েছে ৪০০ শতাংশ এবং ব্যাংকঋণের সুদের হার বেড়ে হয়েছে ১৩ শতাংশ। পণ্য পরিবহনে খরচ কিলোমিটারপ্রতি বিশ্বের মধ্যে প্রায় সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ব্যবসার এই খরচ কমাতে না পারলে আমরা সামনের দিনে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারব না। ফলে আমাদের প্রণোদনা কিংবা ভর্তুকির দরকার নেই, ব্যবসার খরচ কমান।’
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) আয়োজিত তিন দিনব্যাপী ইকোনমিস্ট কনফারেন্সের আজ রোববার দুপুরের অধিবেশনে এসব কথা বলেন অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের এমডি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর।
রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলন শেষ দিনে ‘বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের বহুমুখীকরণের চ্যালেঞ্জ ও কাঠামোগত রূপান্তর’ শীর্ষক এই অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন।
অধিবেশনে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান। অধিবেশনে অনলাইনে যুক্ত হয়ে বক্তব্য দেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) চেয়ারম্যান জায়েদি সাত্তার এবং বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য বেসরকারি খাত বিশেষজ্ঞ সৈয়দ আক্তার মাহমুদ।
সানেম আয়োজিত সম্মেলনের একটি অধিবেশনে বক্তব্য দিচ্ছেন অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর। রোববার রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারেছবি: সংগৃহীত
রপ্তানিতে বাংলাদেশের ভালো সম্ভাবনা রয়েছে উল্লেখ করে অ্যাপেক্সের এমডি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, ওয়ালমার্ট, নাইকিসহ বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ডগুলো চীন থেকে তাদের পণ্য উৎপাদন অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। কারণ, চীনে উৎপাদন কঠিন হয়ে পড়ছে। সেই ব্যবসা নিতে হলে নিজেদের যোগ্য করে তুলতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে হবে।
উদাহরণ দিয়ে সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, ‘বাংলাদেশে একজন বিদেশি বিনিয়োগকারী পাঁচ তারকা হোটেলে থাকতে হলে নিউইয়র্কের মতোই খরচ করতে হয়। হোটেলের খরচ এত ব্যয়বহুল হওয়ার কোনো কারণ নেই। ব্যবসার খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণেই মূলত এমনটা হয়েছে। তার মানে, খরচ কমিয়ে আমাদের প্রতিযোগিতাসক্ষম হতে হবে। অন্য দেশে রপ্তানিকারকেরা ১ শতাংশ সুদে অর্থায়ন পেলেও আমাদের দেশে তা পেতে ১৩ শতাংশ লাগে। তার বাইরে পরিষেবা ও পরিবহন খরচ বেশি। শ্রমের মজুরিও বাড়ছে। এখন প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশ হলে সেটি সম্ভব হবে না। তাই এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে।’
দেশের রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকনির্ভর থাকা প্রসঙ্গে সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, ‘দেশের রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল বা ইপিজেড থেকে মোট পণ্য রপ্তানির ৫৫ শতাংশ তৈরি পোশাকবহির্ভূত পণ্য। আর ইপিজেডের বাইরে মোট রপ্তানির ৮৫ শতাংশ তৈরি পোশাক। তাহলে ইপিজেডের ভেতরে কী জাদু আছে? জাদু হচ্ছে, সব খাতের জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা। যদিও অনেক বছর পর আমরা কিছু পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি। গত মাসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তৈরি পোশাকের মতো চামড়া ও চামড়াজাতসহ তিনটি খাতকে সমান সুযোগ দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। নিচের দিকেও সেটি বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে।’
পণ্য রপ্তানি বহুমুখীকরণে নীতি সংস্কারে জোর দেওয়ার কথা বলেন অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের এমডি। তিনি বলেন, ‘ভিয়েতনামের কাস্টমস থেকে কাঁচামাল ছাড়াতে দুই পাতার ফরম পূরণ করতে হয়। আর বাংলাদেশে ১২ পাতা। আমাদের এই জায়গা সহজ করতে হবে।’
২০০৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১৬ বছরে বাংলাদেশ চার ডিজিটের এইচএস কোডের মাত্র নয়টি নতুন পণ্য রপ্তানিতে যোগ করতে পেরেছে। ২০২১ সালে এসব পণ্যের মূল্য ছিল ৮২ কোটি ডলার। অথচ এই সময়ে ভিয়েতনাম ৪১টি নতুন পণ্য রপ্তানি করেছে। এসব পণ্যের রপ্তানি পরিমাণ ১ হাজার ৪৫০ কোটি ডলার।
এই তথ্য দিয়ে মূল প্রবন্ধে সেলিম রায়হান বলেন, ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের রপ্তানি কাছাকাছি ছিল। তবে কাঠামোগত সংস্কারের মাধ্যমে ভিয়েতনাম নতুন উচ্চতায় উঠে গেছে। তাদের রপ্তানি খাত বর্তমানে বৈচিত্র্যময়, যেখানে সহজ ও জটিল পণ্য রয়েছে। অথচ বাংলাদেশ এখনো সহজ পণ্যই বেশি করে। এই জায়গা থেকে বের হতে হলে কাঠামোগত সংস্কার লাগবে। প্রযুক্তিনির্ভর পণ্য রপ্তানিতে না গেলে পরবর্তী ধাপে যাওয়া সম্ভব না।
প্রশ্নের জবাবে সেলিম রায়হান বলেন, বাংলাদেশে নীতি সংস্কার করা সহজ। তবে তা বাস্তবায়ন খুবই কঠিন। নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মধ্যকার দূরত্ব কমাতে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার দরকার। একই সঙ্গে করব্যবস্থায় বড় ধরনের সংস্কার করতে হবে। কারণ, ৭০ শতাংশ করই পরোক্ষ কর থেকে আসছে।
ভিয়েতনামের উদাহরণ দিয়ে বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য বেসরকারি খাত বিশেষজ্ঞ সৈয়দ আক্তার মাহমুদ বলেন, নব্বইয়ের দশকে ইলেকট্রনিক পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম প্রায় একই জায়গায় ছিল। বর্তমানে ভিয়েতনামের ইলেকট্রনিক পণ্যের রপ্তানি ১০০ বিলিয়ন ডলারের ওপরে। আর বাংলাদেশে রপ্তানি খুবই নগণ্য। ভিয়েতনামের এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই। তাদের ইলেকট্রনিক পণ্যের রপ্তানির ৭০ শতাংশ এফডিআই থেকে আসে। আইনকানুন, নীতির অনিশ্চয়তাসহ বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশে এফডিআই কম বলে মন্তব্য করেন এই অর্থনীতিবিদ।
অন্যদিকে কাঁচামাল আমদানিতে উচ্চ শুল্ক রপ্তানি বহুমুখীকরণে মূল বাধা হিসেবে কাজ করছে বলে মন্তব্য করেন জায়েদি সাত্তার। তিনি বলেন, আমদানি শুল্ক কমানো না গেলে রপ্তানিতে কখনোই বহুমুখীকরণ সম্ভব হবে না।